শেখ ইমন, ঝিনাইদহ :
কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অভীষ্ট (ভিশন) হিসেবে বলা হয়েছে,‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। লক্ষ্য (মিশন) হিসেবে বন্দীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ, যথাযথভাবে তাঁদের বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের জন্য উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত বন্দির চাপে সেই মিশন ও ভিশনে বিপর্যয় ঘটেছে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারটিতে।
শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানে কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। বন্দির চাপে কারাগারটিতে ঠাঁই নেই অবস্থা। তবুও গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে বন্দিদের। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন আসামিকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এতে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বন্দি নিয়ে চলছে কারাগারের কার্যক্রম।
বন্দির চাপ সামলাতে যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে কারাগার কর্তৃপক্ষকে। ঠিক তেমনি অতিরিক্ত বন্দির কারণে বন্দিরা নিজেরাও নানা সমস্যা পোহাচ্ছেন। কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দীর থাকার জন্য ন্যূনতম ছয় ফুট করে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের জায়গা থাকতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত বন্দীর কারণে সেই বিধি ব্যহত হচ্ছে। কারাগারটির শৌচাগার ও গোসলখানার অবস্থাও নাজুক।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, জেলাব্যাপী পুলিশি অভিযানের মুখে বিএনপি ও জামায়াতের পদধারী নেতা ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার নেতাকর্মী বাড়িছাড়া। গত এক সপ্তাহে বিএনপি-জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দল দুইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জেলায় গত ১৫ দিনে ৪টি নাশকতা মামলায় শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত প্রায় ১৩শ’ নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তথ্যমতে, কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর থেকে গত ৮ দিনে বন্দি বেড়েছে ১০৩ জন। এই নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে মোট বন্দির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০৫ জন।
ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের জেলার শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন হায়দার জানান,‘কারাগারটি ৩৮২ জন বন্দীর ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। অথচ বর্তমানে বন্দি আছে ৭০৫ জন। অতিরিক্ত ৩২৩ জন বন্দি বেশি রয়েছে কারাগারটিতে।’
অতিরিক্ত বন্দি থাকার বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের নারী ডেপুটি জেলার তানিয়া জামান বলেন,‘অতিরিক্ত বন্দি থাকলেও এখানে বন্দিদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বন্দিদের খাবারসহ যাবতীয় সমস্যা বিধি মোতাবেক সমাধান করা হচ্ছে। নতুন বন্দি কারাগারে আসার পর তাদের জন্য সরকারিভাবে খাবারও বরাদ্দ থাকছে।’
এদিকে, বন্দিরা তাদের স্বজনদের জানাচ্ছেন, ‘কারাগারে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। কারাভ্যন্তরের ক্যান্টিনে বাহিরের থেকে দশগুণ বেশি দামে খাবার বিক্রি করা হয়।
জামিন নিয়ে ঝিনাইদহ কারাগার থেকে বের হয়ে আসা ব্যক্তিরা জানান,‘কারাগারের ক্যান্টিনে গরুর মাংস ১৬০০ টাকা কেজি। প্রতি ছোট ছোট পিসের দাম ধরা হয় ৭০ টাকা। পোল্ট্রি মুরগির ছোট ছোট প্রতি পিস ৪০ টাকা। সেই হিসেবে কেজি পড়ে ৯৬০ টাকা ও ছোট ছোট পোনা ও বাটা মাছ প্রতি পিস ৫০ গ্রাম ওজনের ৬০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। কারা ক্যান্টিনে অতিরিক্ত দাম নিলেও খাবারের মান ভালো নয় বলে অভিযোগ সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের।’
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের জেলার শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন হায়দার জানান,‘সারা দেশের মতো এখানেও একই নিয়মে ক্যান্টিন পরিচালনা করা হয়। বাইরের থেকে এখানে দাম বেশি এটা সত্য।
তিনি জানান, কারা ক্যান্টিন পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটি আছে। সেই কমিটিতে জেল সুপারসহ কারা কর্মকর্তারাও রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী ক্যান্টিন চালানো হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ সাইদুল আলম জানান,‘আধুনিক সমাজে কারাগার মানেই শাস্তির জায়গা নয়, কারাগার হচ্ছে সংশোধনাগার। কারাগারে যেহেতু বন্দির সংখ্যা দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি সেক্ষেত্রে বন্দিদের অসুবিধা হবে এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ একজন বন্দি আগে যতটুকু বিছানার মধ্যে থাকতে পারতো বর্তমানে আরও কয়েকজনকে নিয়ে সেই একই স্থানে থাকতে হচ্ছে। এতে করে বন্দিদের কারাগারে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। বন্দিদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’