আগামী ২৬ অক্টোবর একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে ইসির পক্ষ থেকে। ওই চিঠির সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে একটি ‘ধারণাপত্র’ দেওয়া হয়েছে। এই পত্রে ইসির এমন অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। ইসি সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, এই ধারণাপত্রটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই তৈরি করেছেন। পরে কমিশনের অন্য সদস্যরা তাতে সম্মতি দিয়েছেন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে ইসির এমন অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরে পরিস্থিতি যদি ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে সেটা তাকে আগেই বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারকে বলতে হবে– নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হলে তপশিল ঘোষণা করা যাচ্ছে না। ইসিকে সহায়তা করাও সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কারণ সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা আছে– ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’অবশ্য ইসি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি যাই হোক; বর্তমান সংসদের মেয়াদ পূরণের আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আরও একটি ‘সহিংস নির্বাচন’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সহিংসতার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে ইসির পক্ষ থেকে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়ে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এবার ভিন্ন চিন্তা করছে ইসি। এবার তারা আগামী নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে সক্রিয় ভূমিকায় রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। মূলত নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কা থেকেই এমন পরিকল্পনা করছে ইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল সমকালকে বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ইসিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরবর্তী নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি তার সামাজিক ও নৈতিক দায় থেকে তপশিল ঘোষণার আগে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশও বিবেচনায় নিতে হবে। সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ইসিকে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই তারা তপশিল ঘোষণার আগে পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে বলতে পারে। কারণ এমন বিরোধপূর্ণ পরিবেশে তপশিল ঘোষণা করলে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা– সেটাও ইসিকে নির্ণয় করতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, যেনতেন নির্বাচন এবার করা কঠিন হবে। কারণ এবারের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আগের দুইবারের মতো নির্বাচন করে ইসিও পার পাবে বলে মনে হচ্ছে না। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের ঘোষণা দিয়ে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়েছিল। এখন তাদের বক্তব্যেই সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দল তাদের আস্থায় নেবে কীভাবে? তারা নিজেরাই বলছে, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ হয়ে ওঠেনি। আবার বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তপশিল ঘোষণা করে দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্ট করার সাংবিধানিক ম্যান্ডেট ইসির নেই। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে সংসদের মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ১২৬ অনুচ্ছেদে ইসির চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করতে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে বলা হয়েছে।
ইসির বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশ’ সৃষ্টির জন্য তারা সরকারকে বলুক। কারণ এই ম্যান্ডেট ইসিকে সংবিধান দিয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কাছে পাঠানো ইসির পাঠানো ওই ‘ধারণাপত্রে’ আরও বলা হয়েছে, কমিশন এককভাবে নির্বাচন সম্পর্কিত সব দায়িত্ব পালন করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের নির্বাহী বিভাগের সহায়তা অনিবার্য। সংবিধান ও আইনে সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সরকার সে বিষয়ে অবহিত। তাই সক্ষমতার অবস্থান থেকে সরকার নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কমিশনও নিজস্ব সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে যাচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, এর পরও বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা ব্যক্ত করা হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক হয়ে থাকে সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তবে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনও হয়ে ওঠেনি। প্রত্যাশিত সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দলগুলো নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও অবস্থানে অনড়। রাজপথে মিছিল, জনসমাবেশ ও শক্তি প্রদর্শন করে সমর্থন প্রদর্শনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত মীমাংসা বা সংকটের নিরসন হচ্ছে বলে কমিশন মনে করে না। বিষয়টি রাজনৈতিক। নির্বাচন কমিশনের এ ক্ষেত্রে করণীয় কিছু নেই।
এতে আরও বলা হয়, রাজনীতিতে মতভেদ, মতানৈক্য ও সংকট হতেই পারে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান খুঁজলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। কমিশন গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করে না; নির্বাচন নিয়ে কাজ করে। তবে নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ ও বাহন। নির্বাচন আয়োজনে যদি সংকট নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকে, তাহলে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।